আমি এবং আমরা ভীড় ভীড় করতে করতে পঞ্চান্ন হাজার পাচঁশত আটানব্বই বর্গমাইলের লাশটি দেখতে থাকি। তার বুক থেকে অবিরল লাল রঙ ঝরতে থাকে, তার কিনারার দিকে গাঢ় সবুজ কষ ছড়াতে থাকে। আমি এবং আমরা তার দীঘল দেহ ঘিরে পরস্পরের দিকে বিজয়ী ভঙ্গিতে তাকাই। যাক, ফেঁড়ে ফেলা গেছে, আমূল বিদ্ধ হয়ে গেছে তার আগপাশতলা। তার মুখে বর্ণমালা লেপ্টে আছে লালার মত। আমাদের ক'জন তাতে ছাই ছুঁড়ে দেয়। কোন শব্দ যেন না উঠে ঐ দগদগে ঘা থেকে। তার শরীর এখনো অল্প অল্প মুছড়াতে থাকে, তাতে আমরা খানিক বিচলিত হয়ে পড়ি। তার অল্প অল্প নিঃশ্বাস পড়তে থাকে, আমরা বিস্মিত হতে থাকি। উপরের দিকে খোলা আকাশের দিকে কোনকালে তার অধিকার ছিলোনা, আজো নেই কিন্তু দেখি সে তাকিয়ে আছে খোলা আকাশের দিকে। আমরা এতে উত্তেজিত হয়ে পড়ি। আমাদের একজন বলে, এখনো নড়ছেরে, এখনো নড়চে। সংগে সংগে আমাদের কজন হাতুড়ি দিয়ে লগি দিয়ে কাটা রাইফেল দিয়ে বেয়নেট দিয়ে রামদা দিয়ে হকিস্টিক দিয়ে বৈঠা দিয়ে চাপাতি দিয়ে আবারো ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরো এক দংগল লাল রঙে ভরে উঠে দিগ্বিদিক, আরো এক দংগল সবুজ কষ দিয়ে ভরে উঠে দিগ্বিদিক। আমরা সুখী সুখী বোধ করি, লাল সবুজের আল্পনাটা তৈরী হলো বলে আমরা কৃতার্থ বোধ করি, গর্ববোধ করি, গর্বে আমাদের বুক চারতলা দালানের সমান দশতলা দালানের সমান চব্বিশ তলা দালানের সমান উঁচু হয়ে যায়। বিজয়ী নিশান উড়াতে উড়াতে আমরা পরস্পরের দিকে প্রশংসা দৃষ্টিতে তাকাই। এত তাগদ্ আমাদের মধ্যে ছিলো ভেবে আমরা অবাক হয়ে যাই। আমরা কোলাকুলি করি, হ্যান্ডশেক করি। পরস্পরকে আসসালামুআলাইকুম বলি, জাঝাকাল্লাহ বলি, সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করি, চব্বিশ তলা দালানের সমান উঁচু বুকে ক্রুশ কাটি, বামদিকে এবং ডানদিকে ঝুঁকে, উপরে এবং নিচের দিকে বেঁকে, আড়াআড়ি এবং কোনাকুনি দুলে প্রকাশ করতে থাকি আমাদের নিজ নিজ ঈশ্বরের মহিমা। উৎসাহের অতিশায্যে আমাদের একদল উচ্চকন্ঠে আজান দিতে থাকে, গলায় নানান সুর আর উঠানামা খেলাতে থাকে, আজানের সুমধুর ধ্বনি আমাদের কানে ঢুকতে থাকে শরাবে তহুরার মত, আমরা আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ি, আরো তাগদওয়ালা হয়ে পড়তে থাকি। আগ্রহের বিস্তর বিস্ফোরনে আমাদের একদল শ্লোকের পর শ্লোক আওড়াতে থাকে ওঁম ওঁম শব্দ উঠতে থাকে, ওঙ্কার বাজতে থাকে পুব থেকে পশ্চিমের দিকে , শ্লোকের দুবোর্ধ শব্দাবলি আমাদের কাছে কৃষ্ঞের বাঁশীর মত মনে হয়, আমরা আরো প্রাণবন্ত হয়ে পড়ি, আরো উত্তেজনা বোধ করতে থাকি। বিজয়ের ঘোরে আমাদের একদল পুরাতন নিয়ম নতুন নিয়ম সোনাঅক্ষরে বাঁধানো যিশু এবং তার সুমহান পিতার প্রশংসা করতে থাকে, ঝন ঝন করে ক্রুশ বাজাতে থাকে, বুকে আঁকতে আঁকতে ক্ষত করে ফেলে, বুকে ক্ষত করতে পেরে খুশী হয়ে উঠে। বাতাসে ক্রুশের সাঁই সাঁই শব্দে আমরা আরো পুলকিত হয়ে উঠি, আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ি। বিস্ময়ের বেদম ঘোরে আমাদের একদল স্হানুর মত হয়ে যায়, ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়ে, ত্রিপিটকের ছন্দসুর গমগম করে উঠে চারপাশ, নাভিমূল থেকে নাদ উঠে, সে শব্দে আমরা আরো প্রমত্ত হয়ে উঠি, আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ি। কিন্তু বাদ সাধলেন আমাদের দেবতারা। মরুভূমির দিকে ঝমুনা পাড়ের দিকে জ্যোৎস্না রাতের দিকে ছাড়াও আমাদের আরো দেবতারা আছেন। সবসময় থাকেন। যদিও মরুভূমির কিংবা ঝমুনাপাড়ের কিংবা জ্যোৎস্নারাতের কিংবা পুবের কিংবা পশ্চিমের কিংবা উত্তরে কিংবা দক্ষিনের দিকের কোন দেবতাই আপত্তি করেননি, মরুভূমির দেবতা অবলীলায় ঝমুনার পাড়ের দেবতার মহিমা শুনেছেন, নামিয়ে দেননি কোন মশা কিংবা হাতি বাহিনী, দুইভাগ করে ফেলেননি পদ্মাকে , ঝমুনার পাড়ের দেবতা অবলীলায় শুনেছেন জ্যোৎস্না রাতের দেবতার মহিমা, কোন রথ বাহিনী পাঠাননি, অগ্নি গোলা বর্ষন করেননি স্বর্গ হতে। কিন্তু পুব আর পম্চিমের আর উত্তর আর দক্ষিনের প্রার্থনা গুলো সম্বসরে আমাদের লোকাল দেবতাদের কানে যেতেই তাদের ঈমান এবং আকিদা এবং আখলাক এবং পরজন্ম এবং বহুজন্ম এবং সৎকৃতি সমূহ আমূল কেঁপে উঠলো, সুক্ষ এবং স্থুল অনুভূতিতে নানাবিধ আঘাত পেয়ে তাদের হাত এবং গলা এবং দৃশ্যমান অদৃশ্যমান অংগ প্রতংগ গুলো ঝনঝন করে বনবন করে ঠনঠন করে টনটন করে কাঁপতে লাগতো।